এখনকারদিনে বাংলা টেলিভিশিন জগতের অত্যন্ত পরিচিত একজন মুখ সুজি ভৌমিক (Suji Bhowmik)। অল্পদিনেই নিজের সাবলীল অভিনয় দক্ষতা দিয়ে তিনি মন জয় করে বাংলার অগণিত দর্শকদের। তবে সুজয় থেকে তাঁর আজকের এই সুজি হয়ে ওঠার গল্পটা একেবারেই সহজ ছিল না। অনেক ঝড়ঝাপ্টা,সমাজের চোখ রাঙানি,অপমান সহ্য করে চোখের জল ফেলে দেরিতে হলেও শেষ পর্যন্ত সার্থক হয়েছে তাঁর অভিনেত্রী হয়ে ওঠার লড়াই।একটা সময় ছিল যখন ট্রান্সজেন্ডার হওয়ায় লোকে কি বলবে, কি নজর তাকাবে, এককথায় লোকের হাসির পাত্র হওয়ার ভয়ে নিজেকে সারাক্ষণ লুকিয়ে রাখতেন সুজি। যে কারণে অভিনেত্রীর কথায় তার ছোটবেলাটা একেবারে নষ্ট হয়ে গিয়েছে। ন না পারতেন ছেলেদের মতন জীবন যাপন করতে, না পারতেন মেয়েদের মত বাঁচতে।
ছেলেদের মধ্যে গেলে তার হাব ভাব যেহেতু মেয়েদেরই মতন তাই কেউ তাকে খেলতে নিত না। আবার তাকে যেহেতু ছেলেদের মতো দেখতে তাই মেয়েদের মধ্যে গেলে তারাও তাকে তাড়িয়ে দিত। জন্ম থেকেই তাকে যেহেতু ছেলেদের মতো দেখতে। কিন্তু ভিতর থেকে তিনি মেয়েদের মত। অর্থাৎ নারী স্বাত্তাটাই অনুভব করতেন সারাক্ষণ। তাই চুল বাধতে কিংবা নেলপালিশ পরতে ভালবাসতেন তিনি। তবে শুরুর দিকে তিনি নিজেও ঠিক বুঝতে পারতেন না তিনি আর পাঁচ জন ছেলেদের থেকে এতটা আলাদা কেন।
তবে পরবর্তীতে যখন তিনি একটু বড় হলেন এবং ধীরে ধীরে সমকামী শব্দটার সাথে পরিচিত হলেন তখন তিনি বুঝলেন যে তিনি আসলে ওই দলেই পড়েন। পরবর্তীতে ক্লাস টেনের মাধ্যমিক দেওয়ার পর তিনি তারই মত আরও এমন অনেক মানুষ খুঁজে পেলেন যাদের সাথে দলবেঁধে এনজিও করে আওয়াজ তুলতে শুরু করলেন নিজের সত্তার পক্ষে। তবে একটা সময় তার নিজের পরিবারের লোকও তাকে বুঝতে চাননি । তবে মা তো মা-ই হয়।
তাই সুজির মাও একটা সময় তাকে বুঝেছিলেন। আজ সুজি টেলিভিশন জগতের জনপ্রিয় অভিনেত্রী হলেও একটা সময় তার অভিনয় যাত্রা শুরু হয়েছিল নাটক এবং থিয়েটারের মঞ্চ দিয়ে। যুক্ত ছিলেন নান্দিকারের সাথেও। তিনি নাটক নিয়েই মাস্টার্স করেছেন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। অভিনেত্রীর কথায় জানা যায় তার পরিবার ব্যাকগ্রাউন্ড ছিল পড়াশোনার। বাবা ছিলেন প্রফেসর মা ছিলেন শিক্ষিকা।তাছাড়া সুজয় অর্থাৎ সুজিও ছোট থেকে পড়াশোনায় ভালো ছিলেন।
তাই আর পাঁচটা মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারের মতো তার বাবা মা ও চেয়েছিলেন তিনি পড়াশোনা করে চাকরি করে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হোন। কিন্তু সুজি চেয়েছিলেন অভিনয় যেহেতু তাঁর প্যাশন তাই অভিনয় নিয়েই তিনিএগোবেন। সম্প্রতি তিনিএক্কাদোক্কা ধারাবাহিকে ভিলেনের চরিত্রে অভিনয় করেছেন। এই ধারাবাহিকে তাকে প্রথম একজন মহিলা নার্সের চরিত্রে দেখা গিয়েছে। লেখিকা লীনা গাঙ্গুলি (Leena Ganguly) এবং শৈবাল বন্দ্যোপাধ্যায় তাকে এই সুযোগ করে দিয়েছেন।
এর আগে জি বাংলার জনপ্রিয় ধারাবাহিক ফিরকি (Phirki)-তে একজন রূপান্তরকামী (Transgender) চরিত্রে অভিনয় করে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন তিনি। ধারাবাহিকে এই চরিত্রটি ছিল পজেটিভ। তবে সুজির বরাবরের ইচ্ছা নারী চরিত্রে অভিনয় করার। তা সে পজিটিভ হোক কিংবা নেগেটিভ। যদিও একটা সময় তিনি নিজেও ভেবেই নিয়েছিলেন রূপান্তরকামী চরিত্র ছাড়া তাকে কেউ কোনদিন নারী চরিত্রে ভাববেনই না। যদিও সেই মিথ ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছেন লেখিকা লীনা গাঙ্গুলী।
তিনিই তাকে প্রথম নারী চরিত্রে অভিনয় করার সুযোগ করে দিয়েছেন। প্রসঙ্গত সুজির জীবনের লড়াইটা যেহেতু ভীষণ কঠিন। তাই তাঁর জীবনে আক্ষেপও রয়েছে অনেক। আজ তিনি অভিনেত্রী হিসেবে জনপ্রিয়তা পেয়েছেন ঠিকই কিন্তু এক সাক্ষাৎকারে অভিনেত্রী জানিয়েছেন পরের জন্মে তিনি কুকুর, বিড়াল,পিঁপড়ে সবকিছু হতে চাইবেন কিন্তু সুজি হয়ে আর জন্মাতে চান না। তার কারণ এই জন্মে তাকে রূপান্তরকামী হওয়ার জন্য এমন অনেক অপমান সহ্য করতে হয়েছে যা জল এনে দেবে চোখে। এমনকি কিছুদিন আগেও তার সাথে এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে তাকে। যার জন্য থানায় গিয়ে ডায়েরী পর্যন্ত করতে হয়েছিল তাকে। তাই সুজি মনে করেন জীবনে সম্মান আর শান্তির কাছে নাম-যশ খ্যাতি কিছুই না।