সত্তরের দশকের অন্যতম দাপুটে অভিনেত্রী হলেন শর্মিলা ঠাকুর (Sharmila Thakur)। বাংলার সাথে রয়েছে যার শিকড়ের টান। কিংবদন্তি পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের (Satyajit Ray) সিনেমার নায়িকা তিনি। দেশজোড়া নাম-ডাক আর খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছেও আজও তাই নিজেকে বাঙালি বলে পরিচয় দিতে গর্ব বোধ করেন অভিনেত্রী। ১৯৫৯ সালে প্রথমবার শর্মিলা ঠাকুরের সাথে পরিচয় হয় দর্শকদের।
এই বছর সত্যজিৎ রায় পরিচালিত ‘অপুর সংসার’ সিনেমায় অপর্ণা হয়েই ধরা দিয়েছিলেন অভিনেত্রী। যদিও তখন তিনি সবেমাত্র পঞ্চদশী। মাথায় এক ঢাল কালো চুল, টানা টানা চোখ পরনে ছিমছাম আটপৌরে শাড়ি, আর মুখে অদ্ভুত মিষ্টতা নিয়ে বছর ২৩-এর সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের নায়িকা হয়ে উঠেছিলেন ঠাকুরবাড়ির এই মেয়ে। শুরু থেকেই ঐতিহ্য আর আভিজাত্যের মিশেল শর্মিলা।
আসলে শর্মিলা ঠাকুরের সাথে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরিবারের ছিল রক্তের সম্পর্ক। অভিনেত্রীর বাবা গীতীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন স্বয়ং গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাতি। সত্যজিৎ রায়ের সাথে কাজ করার পাশাপাশি বাংলায় শর্মিলা কাজ করেছেন তপন সিংহ, অজয় করের মত নামজাদা পরিচালকদের সাথে। পরবর্তীতে ১৯৬৪ সালে মাত্র কুড়ি বছর বয়সেই মায়া নগরী মুম্বাই পাড়ি দিয়েছিলেন শর্মিলা। এই বছর ‘কাশ্মীর কি কলি’ সিনেমায় শাম্মী কাপুরের বিপরীতে জুটি বেঁধেই পেয়েছিলেন দারুন সাফল্য।
এছাড়া রাজেশ খান্নার সাথে শর্মিলার জুটি নিয়ে তো আলাদা করে কিছু বলারই নেই। তবে সিনেমার মতোই বর্ণময় ছিল অভিনেত্রীর ব্যক্তিগত জীবন। এমনিতে বিনোদন জগতের সাথে ক্রিকেট দুনিয়ার যোগাযোগ আজকের নয়। বিশেষ করে বাংলার ঠাকুর পরিবারের সন্তান শর্মিলা ঠাকুরের সাথে নবাব মনসুর আলি খান পতৌদির (Mansoor Ali Khan Patoudi) প্রেম কাহিনী (Love Story) তো ইতিহাস হয়ে গিয়েছে।
সেই সময়ে তাদের প্রেম থেকে শুরু করে বিয়ে সবকিছুই একাধিকবার জায়গা নিয়েছে সংবাদ শিরোনামে। হিন্দু মুসলিম ভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের বিয়ের ক্ষেত্রে আজও তাঁরা অনেকের কাছে অনুপ্রেরণা। শর্মিলার অভিনয় জীবন যখন সাফল্যের মধ্যগগনে তখনই তিনি প্রেমে পড়েন তৎকালীন ভারতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক নবাব মনসুর আলি খান পতৌদির।
অভিনয় থেকে শুরু ব্যক্তিগত জীবন সব ক্ষেত্রেই বরাবরই ছক ভাঙা শর্মিলা ঠাকুর। তাই বাঙালি হিন্দু তারওপর ঠাকুর পরিবারের সন্তান হয়ে সেই যুগে দাঁড়িয়েও মুসলিম পরিবারে বিয়ে করার সাহস দেখিয়েছিলেন অভিনেত্রী। আসলে শর্মিলা আর টাইগারের সত্যিকারের ভালোবাসার সামনে ফিকে হয়ে গিয়েছিল জাতি-ধর্মের মতো তুচ্ছ বিষয়।
সে সময় শর্মিলা টাইগারের প্রেম থেকে বিয়ে কার্যত সাড়া ফেলে দিয়েছিল গোটা দেশে। একে তো ভিন্ন ধর্মের বিয়ে তার ওপর হিন্দু মেয়ে মুসলিম ছেলে। তবে নিন্দুকদের মুখে ছাই দিয়ে শর্মিলা টাইগারের সেই বিয়ে টিকেছিল চল্লিশ বছরেরও বেশি সময়। ২০১১ সালে পাতৌদির মৃত্যুর আগে পর্যন্ত সুখে সংসার করেছেন তাঁরা। তবে অনেকেই হয়তো জানেন না এই হিন্দু মুসলিম বিয়ের আগে শর্মিলা টাইগারকে কিছু শর্ত দিয়েছিলেন।
তবে না ধর্ম কিংবা বিয়ে নিয়ে কোন শর্ত ছিল না অভিনেত্রীর। পাতৌদির নবাবকে বিয়ের আগে শর্মিলা শর্ত দিয়েছিলেন একটা ম্যাচে পরপর তিনটি ছক্কা মারতে হবে। তবেই তাঁকে বিয়ে করবেন তিনি। শর্মিলার কথা রাখতে তা করেও দেখিয়েছিলেন তৎকালীন ভারতীয় দলের ক্যাপ্টেন নবাব মনসুর আলী খান পাতৌদি। তারপর তো বাকিটা ইতিহাস। রাস্তায় হাঁটু গেড়ে বসে শর্মিলাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন তিনি। বিয়ের পর তিন সন্তান সইফ, সোহা এবং সাবাকে নিয়ে সংসার সামলাতে কিছুদিন অভিনয় থেকে দূরেও ছিলেন অভিনেত্রী। তবে তা নিয়ে কোনদিনই আফসোস ছিল না এই বঙ্গতনয়ার।
হিন্দু হয়ে মুসলিমকে বিয়ে করে আজীবন কম কথা শোনেননি অভিনেত্রী। সম্প্রতি এক সংবাদমাধ্যমে টাইগারের সাথে প্রেম নিয়ে মুখ খুলেছিলেন শর্মিলা। অভিনেত্রী জানান ক্রিকেট ছাড়াও মনসুরের ব্রিটিশ উচ্চারণে ইংলিশ বলা তাকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করেছিল। এছাড়া তিনি জানান মনসুরের সেন্স অফ হিউমার খুব ভাল ছিল। তিনি নাকি নিজে জোক বলে নিজেই হাসতেন। তাছাড়া তাঁকে দেখে শর্মিলার মনে হয়েছিল তিনি তাকে কখনও কষ্ট দেবেন না। তার মনে হয়েছিল তিনি মনসুরকে ভরসা করতে পারেন।