বাঙালি দর্শকদের বিনোদনের সাথে রুপোলি পর্দার সম্পর্ক কয়েক দশককে পুরোনো। নেক শিল্পী ছিলেন যাদের দৌলতে সমৃদ্ধ হয়েছিল বাংলা সিনেমা। এমনই একজন বিখ্যাত অভিনেতা ছিলেন তুলসী চক্রবর্তী (Tulsi Chakraborty)। অভিনেতার নামটা উঠলেই সকলের মনে সবার আগে ভেসে ওঠে ‘পরশ পাথর’ (Parash Pathar) ছবির দৃশ্য। তবে অভিনেতা হিসাবেও তিনি ছিলেন ইন্ডাস্ট্রির খাঁটি পরশ পাথর। নিজের দুর্দান্ত অভিনয় ক্ষমতায় প্রতিবারেই মুগ্ধ করতেন দর্শকদের।
সে যুগে বাংলার কিংবদন্তি অভিনেতা বলতে যে কয়েকজনের নাম উঠে আসে তাদের মধ্যেই অন্যতম একটি তুলসী চক্রবর্তী। কিন্তু টলিউড তাকে তাঁর যোগ্য সন্মান টুকুই দেয়নি। এমনকি অভিনেতার মৃত্যুর পর তীব্র অর্থ কষ্টের সম্মুখীন হয়েছিলেন তাঁর বিধবা স্ত্রী।
আজকের মত ঝাঁ চকচকে রুপোলি পর্দা তো দূর রঙিন ছবিও ছিল না সেই সময়ে। তবে অভিনয়ের মধ্যে দিয়েই প্রতিটা চরিত্রকে এতটাই জীবন্ত করে তুলতেন, যে রেশ থাকত বেশ কয়েকদিন। পর্দার অভিনয় আর বাস্তবতার পার্থক্য করা মুশকিল হয়ে যেত। ডায়লগ নয় চোখের এক্সপ্রেশনই যথেষ্ট ছিল মনের ভাব বোঝানোর জন্য। এমন এখন রত্নের কদর করেনি টলিউড।
আসলে ছোট থেকেই দরিদ্র পরিবারে মানুষ হয়েচিলেন তুলসী চক্রবর্তী। ১৮৯৩ সালে জন্ম হয়েছিল তাঁর। এরপর বড় হয়ে অভিনেতা হিসাবে প্রথম পর্দায় আসেন ১৯৩২ সালে। অবশ্য সিনেমায় আসার আগে যাত্রাপালা থেকে নাটকের মঞ্চে নিজের পরিচিতি গড়ে তুলেছিলেন অভিনেতা। প্রথম ছবি ছিল ‘পুনর্জন্ম’। এরপর একে একে পরবর্তী ছবিগুলিতে দুর্দান্ত অভিনয় করে দর্শকদের মনে স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছিলেন তিনি।
আজ থেকে কয়েক দশক আগে, পঞ্চাশের দশকে একই বছরে ১২টি ছবি মুক্তি পেয়েছিল তুলসী চক্রবর্তীর। কিন্তু তাতেও দারিদ্রতা কাটেনি। ট্রামে-বসে যাতায়াত করেই কাটিয়েছিলেন আজীবন। আসলে অভিনয়ের জন্য পারিশ্রমিক নিয়ে কখনোই দরাদরি করতেন না তিনি। যে কোনো চরিত্রেই নামমাত্র পারিশ্রমিকে রাজি হয়ে যেতেন।
আসলে ছোট থেকেই অভাবের সংসার বড় হয়ে ওঠার কারণে সংগ্রাম করতে হয়েছিল অনেকটাই। তাই নিজের মূল্যটা হয়তো বুঝতেন না তিনি। সাথে ভয় ছিল যদি পারিশ্রমিক বাড়ালে কাজ পাওয়া বন্ধ হয়ে যায়! তাই যেটুকু পারিশ্রমিক পেতেন তাতেই রাজি হয়ে যেতেন। কিন্তু এর ফলে তিনি পরলোক গত হওয়ার পরে চরম দারিদ্রতার শিকার হন তাঁর স্ত্রী। ৬২ বছর বয়সে তুলসী চক্রবর্তী মারা গেলে আর্থিক সংকটে পড়েন স্ত্রী। এমনকি ভিক্ষা পর্যন্ত করতে হয়েছিল তাঁকে।
তবে জানলে অবাক হবেন, বাঙালির গর্ব ও বাংলা সিনেমার প্রাণ পুরুষ সত্যজিৎ রায় কিন্তু ঠিক চিনেছিলেন তুলসী চক্রবর্তীকে। যেখানে ইন্ডাস্ট্রির বাকি পরিচালকেরা নামমাত্র পারিশ্রমিকে কাজ করিয়ে নিতেন, সেখানে পরশ পাথর ছবির জন্য মোটা টাকাই তুলে দিয়েছিলেন অভিনেতার হাতে। জানা যায়, ছবির পারিশ্রমিকের অনেক জেনে পরিচালকের হাত ধরে কেঁদেই ফেলেছিলেন তুলসী চক্রবর্তী।
কিংবদন্তি অভিনেতা হয়েও কাজের অনিশ্চয়তার ভয় পেতেন তিনি। ভাবতেন পারিশ্রমিক বাড়িয়ে দিলে যদি আর কাজ না মেলে! তাছাড়া দুর্দান্ত অভিনয়ের জেরে দশকের পর দশক ধরে প্রশংসিত হয়েও না পেয়েছেন জাতীয় পুরস্কার না পেয়েছেন পদ্ম সন্মান। হ্যাঁ একাধিক মেডেল পেয়েছিলেন অভিনয়ের জন্য, তবে জানলে খারাপ লাগবে অর্থের জন্য সেই মেডেল পর্যন্ত বিক্রি করতে হয়েছিল তাঁর স্ত্রীকে। অভিনেতা মারা যাওয়ার পর দুর্দিনে তাঁর স্ত্রীর পাশে দাঁড়ান মিঠুন চক্রবর্তী সাথে কিছু সাহায্য করেছিল আর্টিস্ট ফোরাম।